জানুয়ারি 16, 2022
আমার ছোটবেলার বাংলাদেশ
আমার শেকড় বাংলাদেশের (Bangladesh) ঢাকার “বারদী” (Baradi) গ্রামে। যদিও জন্মকর্ম সবই কলকাতায়। তবে ৮/১০ বছর পর্যন্ত গ্রামের সাথে যোগাযোগ ছিল কারণ আমার ঠাকুমা ওখানে থাকতেন। বাবা,কাকারা চাকরিসূত্রে এবং লেখাপড়ার জন্য এদেশেই থাকতো। ঠাকুমাকে আমরা “দাদামা” ডাকতাম। তাঁর স্নেহ, ভালোবাসার টানে আমরা উন্মুখ হয়ে থাকতাম, কবে তাঁর সান্নিধ্যে আসবো। যেহেতু দেশভাগ তখনও হয়নি কাজেই যাতায়াতের কোনো অসুবিধাই ছিল না। বাবু-কাকুদের সুযোগ হলেই আমরা অবশ্যই চলে যেতাম ওখানে।
শিয়ালদহ স্টেশন (Sealdah Station) থেকে ছাড়তো “গোয়ালন্দ মেল্” (goalanda Mail)। ওই ট্রেনেই আমরা যেতাম। গোয়ালন্দে (Goalanda) নেমে ওখান থেকে বর্ষাকালে স্টিমারে, অন্য সময়ে নৌকায় বারদী (Baradi) পৌছাতাম।
এই গোয়ালন্দ জায়গাটা মনে হয় একটা বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। রেলের জংশন স্টেশন, জাহাজঘাট, ব্যবসাকেন্দ্র সবই ছিল। বিভিন্ন খাবারের দোকান ছিল, বিশেষভাবে ভাতের হোটেল। লোকজন যাওয়া-আসার পথে ওই হোটেলগুলোয় রান্না পদ্মার ইলিশের ঝোল আর গরম ভাতের অমোঘ টানে ওখানে ঢুকতেই হত।
বারদীর স্বনামধন্য লোকনাথ আশ্রমে (Baba Loknath Ashram) গ্রামে ঢুকতে অথবা গ্রাম থেকে বাইরে যেতে অবশ্যই সবাই বাবাকে স্মরণ করতো। লাল মেঝের পাকাঘর আর বারান্দা কিন্তু ছাদ ছিল শনের ছাওয়া। সামনে অনেকটা খোলা জায়গা, তারপর এক “সিদ্ধ বকুল” গাছ। গ্রামের লোকের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ওই গাছের গোড়ার মাটি মাথায়, মুখে দিলে যেকোনো রোগ ভালো হয়।
আমি আমার এই বয়সেও সেই মাটি কোনোভাবে যোগাড় করতে পারলে রাখি কেউ কোনো শুভ কাজে যাওয়ার সময় তাঁর মাথায় ঠেকাই। কয়েক বছর আগে আমার এক ভাই আর এক ভাইপো আমাকে এনে দিয়েছিলো সেই পবিত্র মাটি।
যাইহোক আশ্রমে পৌঁছনোর পরে ওখানে প্রসাদ খেতাম পেট ভরে। সেখানে বাড়ি থেকে দাদামা, যারা চাষবাস করতেন তাদের পাঠিয়ে দিত আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমাদের বাড়ি আশ্রম থেকে মাইল খানেক দূরে ছিল। ছয়/সাত বছর বছর বয়সে ওই পথ হেঁটে যাওয়া অসম্ভব ছিল। কাজেই “ইয়াদালী”, “আককাছআলী” কাকুদের কোলে কোলেই যেতাম।
দাদামা উঠানে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতো। আমাদের দেখতে পেলেই একমুখ হাসি নিয়ে দুহাত বাড়িয়ে আমাদের আদর করতো।
আদরের বহর শেষ হতো নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, খিরের সন্দেশ ইত্যাদি দিয়ে। তারপর ক্লান্তি ও আদরের আবেশে ঘুম এসে যেত।
সকালে ঘুম থেকে উঠে জলখাবার ছিল ফেনাভাত সঙ্গে বাড়ির তৈরী ঘি। এই ফেনাভাতকে বলতো “জাউ”। বেশ লালচে ভাতটা খেতেও খুব স্বাদ। তারপর ছিল মাছ ধরার পালা। জেলেরা যেত জাল নিয়ে কাকুরা খালি হাতে শুধু একটা করে গামছা নিয়ে। বড় পুকুর, তাকে বলতো “বিল”।
একদিকে জেলেরা জাল ফেলেছে আর কাকুরা অন্যদিকে বিলে নেমে যেত। কাকুরা যে কি কায়দায় পা দিয়ে দিয়ে মাছ ধরতো আর পাড়ে আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম, আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিত। আমরা সেগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে মাছ রাখার জায়গায় রাখতাম। মাছ ধরার জায়গার নাম ছিল “ডুলা”।
গ্রামের বেশির ভাগ মুসলমান সম্প্রদায় খুবই গরিব ছিল। সেই সব বাড়ির মহিলারা অনেক বাড়িতে কাজ করতো সংসার চালানোর জন্য। তারা উঠান নিকানো, ধান সেদ্ধ করে ওই উঠানে শুকোতে দিতো, ধান ভেঙে চাল তৈরী করতো। এছাড়াও যাবতীয় বাইরের কাজে তাদের পাওয়া যেত। উঠোনের এক ধারে একসঙ্গে দুটো মাটির উনুন তৈরী করা ছিল কাঠের জ্বালের। তাকে বলতো “দোআখা”। সেই উনুনের ধান সেদ্ধ, মুড়িভাজা, পিঠে-পায়েস রান্না করা সবই হতো।
জ্বালানি ছিল ধান গাছের গোড়া, যাকে বলতো “নাড়া”, গাছের ডালপালা। আর একটা জিনিস যার নাম মনে করতে পারছি না কিন্তু বানাতে দেখেছি। এক-দেড় হাত লম্বা মোটা পাঠকাঠির গায়ে গোবর চেপে চেপে আটকিয়ে শুকিয়ে রাখা হতো। তাই সারা বছর জ্বালানি হিসাবে খুব ভালো ছিল। এইসব কাজের বিনিময় ওরা চাল, মুড়ি, গাছের শাক-সবজি, পুকুরের মাছ ইত্যাদি পেত। নগদ পয়সার অভাব ছিল কাজেই সেটা খুব কমই পেত।
প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি মাছ ধরা হতো। সেই সব মাছ বাড়ি বাড়ি বিলিয়েও শুক্তো থেকে ঝালে-ঝোলে-অম্বলে খেয়ে শেষ হতো না। খাবার পরে বিশ্রামের জায়গা ছিল আমবাগানে। আম গাছের তলা রোজই ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করা হতো। সেখানেই বাংলার বিখ্যাত শীতলপাটি পেতে শুতাম আমরা। গাছ থেকে টুপটাপ আম পড়তো, তা কুড়োবার জন্য আমরা শোয়া থেকে উঠলেই বাবু-কাকুদের বকুনি খেতাম।
বিকেলে ইয়াদালি বা আককাছআলী কাকুর যেকোনো একজন আম রাখার জায়গা নিয়ে আসতো যার নাম ছিল “ঢুলঢুলী”। ওই আম বাগানের পাশ দিয়ে একটা খাল ছিল, তাতে বেশ স্রোতও ছিল। পরিষ্কার টলটলে জল তাতে আমরা সকলে স্নান করতাম।
বাড়ি আর আম বাগানের মধ্যে ছিল গরুর গাড়ি চলার রাস্তা। উঠোন ঘিরে চারপাশে ঘর ছিল। রাস্তার পাশেই ছিল দুটো ঘর। একটা শোবার ঘর আর একটা বৈঠকখানা। ওই বৈঠকখানার কোনায় ছিল একটা কাঁচামিঠে আমের গাছ। আমি এখানেও কাঁচামিঠে আম দেখি, কিন্তু ওই গাছের আমের মত এত বড় বড় আম আমার নজরে পড়েনি। মনে হয় একেকটা ২ সেরের (around 1.8 kgs) মত ওজন। খেতেও তেমনি আস্বাদ।
দাদামার শোবার ঘরটা খুব উঁচু ও বড় ছিল। তাতে একটা খুব বড় চৌকিতে বিছানা। সেই ঘরটায় ছোট একটা ভাগ করা ছিল। তারমধ্যে রোজের খরচ করার মত চাল, ডাল, তেল, ঘি ইত্যাদি থাকতো। আর একটা বাঁশের খুব মজবুত সিঁড়ি ছিল উপরে ওঠার জন্য। তার মেঝেটা ছিল কাঠের পাটাতনের, ছোট জানালাও ছিল কয়েকটা। ওখানে থাকতো সারা বছরের চাল, বিভিন্ন ডাল, তেল, ঘি, আমসত্ত্ব, আচার, কাসুন্দি ইত্যাদি। সেই সময়ের একটা দরজা ছিল যেটা খুলে ঢুকতে হতো, নামার সময় বন্ধ করা হতো। আমিষ-নিরামিষ দুটো রান্নাঘর ছিল, তার পেছনে কুয়োতলা।
ঐখানেও একটা আমগাছ ছিল, “গোলাপখাস”। সেই আম পাকলে একেবারে গোলাপফুলের গন্ধ মম করতো চারপাশ। অসম্ভব মিষ্টি ছিল সেই আম, কিন্তু ছোট ছোট ছিল আকারে।
আমার ৬/৭ বছর বয়সে এক মাসতুতো দিদির বিয়েতে গিয়েছিলাম, ঢাকা (Dhaka) জেলার “হাসাড়া” নামক গ্রামে। পদ্মা (Padma) নদীর গা ঘেঁষা সে গ্রাম। ছোটবেলায় আমি নাকি খুব দুরন্ত ছিলাম কাজেই ঘরে কে কি করছে সে দিকে আমার মন ছিল না যতটা ছিল বাইরের দিকে।
বিয়েবাড়ির বিশেষ কিছুই মনে নেই, বাদে দুএকটা ঘটনা। মাসির বাড়ির দুইপাশে বড় বড় দুটো পুকুর ছিল। সেই একটা পুকুরে দেখলাম বড় বড় বাঁশ ফেলা রয়েছে। ওদের বাড়িতে যারা গরু-বাছুর চড়াতো বা চাষবাসের কাজ করতো তাদের কাজ ছিল আমাদের ছোটদের দেখভাল করার। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম জলে কেন বাঁশ রয়েছে? তাতে ওরা জানালো গ্রামে যখন খুশি মাংস পাওয়া যায় না, সেই জন্য প্রয়োজন মত কচ্ছপের মাংস খাওয়া হয়।
কিছুই বুঝতে পারলাম না কথার অর্থ! পরে বুঝলাম ব্যাপারটা কি। এরই মধ্যে একদিন দেখলাম দুটো বাঁশে উপর অজস্র ছোট ছোট কচ্ছপ উঠে বসে রয়েছে। পুকুরে স্নান, কাপড় কাচা, বাসন মাজা সবই চলছে কিন্তু সেই কচ্ছপগুলো তাদের জায়গায় ঠিক বসে রয়েছ। সেখান থেকেই ধরে এনে মাংসের ব্যবস্থা করা হতো।
এই রকমই আরেকটা ঘটনা হলো, পদ্মার থেকে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরে এনে ভিতর বাড়ি দিয়ে একটা পুকুরের পাড়ে জমা করা হয়েছে, পাঁচ ছয়জন মিলে সেই মাছ কেটে পুকুরের পাড়ে কলাপাতার উপর জমা করছে। সেই কাটা টুকরোগুলো আর ধোয়া হবে না। সেখান থেকে নিয়েই রান্না হবে।
তখন খানিক বড় হয়েছি, বছর নয়/দশ হবে। আমাদের গ্রামে ঢুকতে প্রথমে আমার বাবুর জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি ছিল তারপর খান চারেক বাড়ি পরে আমাদের বাড়ি। সেই জ্যাঠামশাই এর মেয়ের বিয়ে। তখন বর্ষাকাল। নদীমাতৃক বাংলার নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুর… সব জলে একাকার। দেখে বোঝবার উপায় নেই কোনটা রাস্তা, কোনটা পুকুর। সবুজ, সতেজ প্রকৃতি। জীবনানন্দের বাংলার বিবরণ চাক্ষুস করেছিলাম প্রাণ ভরে।
বিয়ের আগের দিন সন্ধেবেলা আমরা নদীর ঘাট থেকে সোজা গিয়ে পৌঁছলাম বাড়ির পুকুর ঘাটে। সেখানে আলো নিয়ে বাড়ির পিসিমা, কাকিমা, জেঠিমা সবাই আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। সেখানেই অনেক আদর খেয়ে বাড়ি ঢুকে মন খারাপ হয়ে গেলো দাদামাকে না দেখে। সবাই বললো খালি বাড়ি রেখে দাদামা আসতে পারেনি, কাল সকালেই আমরা গিয়ে দাদামাকে নিয়ে আসবো।
সকালেই মাঝিরা নৌকা নিয়ে তৈরী। দিদি, আমি, বাবু আর ছোট কাকু রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। গ্রাম বাংলার কি যে শোভা সেদিন চাক্ষুস করলাম। সেই রূপ বোধয় জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব ভাষায় প্রকাশ করার। পুকুর ছেড়ে নৌকা পড়লো ধানক্ষেতে। ওখানে জল বেশি নেই খুব জোর কোমর জল। কারণ মাঝিরা মাঝে মাঝেই নৌকা থেকে জলে নেমে একটু ঠেলে নৌকা নিয়ে যাচ্ছে।
সেই ঠেলায় ও নৌকার গতিতে ধানগাছগুলো নৌকার দুপাশে সরে সরে যাচ্ছে। টলটলে জলের নিচে ছোট ছোট মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাছে গাছে পাখির কলকাকলি। সাথে মনরম প্রভাতি বাতাস। এ যেন অন্য পৃথিবী! আজও এই জীবন সায়াহ্নে এসে অমলিন ও স্থায়ী সেই সুখস্মৃতি। যাইহোক নৌকা ঘরের ঘাটে এসে দাঁড়ালে, মাঝিরা নৌকা থেকে কোমর জলে নেমে আমাদের কোলে করে একেবারে উঠোনে নামিয়ে দিলো। উঠোনে দেখি মাচা ভর্তি শশা ফলে আছে। দাদামা ওগুলো তোলেনি, আমরা এসে গাছ থেকে তুলবো বলে। দাদামা তো আমাদের অপেক্ষায় পথ চেয়েই রয়েছে। এরপর দাদামার আদর ও দাদামার হাতের নানারকমের নাড়ু, মোয়া, আমসত্ত্ব, ক্ষীর ইত্যাদি পেয়ে বিয়ে বাড়ির কথা বেমালুম ভুলে গেলাম।
একবার গ্রীষ্মকালে দাদামার সঙ্গে আমাকে আর দিদিকে বাবু রেখে এসেছিলো। তখন আমরা ছাড়া গরু! শাসন করবার কেউ নেই, সঙ্গে দাদামার আস্কারা তো ছিলই। যথেচ্ছ আম খেয়ে দিদি ও আমার মুখভর্তি ঘা হয়ে গিয়েছিলো। আমার মা ও মেজকাকু আনতে গিয়ে আমাদের হাল দেখে মা খুব বকলো আর মেজকাকু দাদামাকে নিয়ে পড়লো।
যাইহোক আসতে তো হবেই। খুব মন খারাপ, খুব কান্নাকাটি করে মা আর মেজকাকুর সাথে চলে আসলাম, দাদামাকে একা ফেলে। সেই শেষবার গিয়েছিলাম দেশের বাড়িতে। দাদামা পরে কোলকাতাতে চলে আসে এবং এখানেই মৃত্যুবরণ করে। তবে সোনার বাংলার স্মৃতি কোনোদিনই ভোলার নয়। কবি সেই জন্যই লিখেছিলেন , “সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, সার্থক জনম মা গো, তোমায় ভালোবেসে”।