মিথ, ফেয়ারি টেল বা রূপকথা ইত্যাদি নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী একটি অতি খাঁটি কথা লিখে গেছেন। তিনি লিখেছিলেন: “রাজপুত্রর সঙ্গে বাঘের দেখা হলো। বাঘ বললো “হালুম, এবার তোকে খাবো”! এটি রূপকথা সন্দেহ নেই তাই বলে বাঘ যে মানুষ খায় এটা তো সত্যি!”
জগন্নাথ দেবের মিহিদানা প্রীতির যে গল্পটি লিখেছি সেটি এরকমই একটি মিথ। এই মিথ্ নিয়ে অনেকেই জানালেন যে গল্পটা ঠিকই আছে তবে মিষ্টি টা মিহিদানা নয়। ওটা গুটকে সন্দেশ। কেউ আবার বললেন মনোহরা। জনৈক বললেন মিহিদানা ১৯০৪ সালে বর্ধমানে আবিষ্কৃত আর মাহেশের রথ সেই ১৩৯৬। তাছাড়া মাহেশের মিহিদানা বিখ্যাত নয়। কী করে সম্ভব?
জগন্নাথ দেবের প্রিয় মিষ্টি নিয়ে বিতর্ক এই প্রথম নয়। রসগোল্লা বস্তুটিকে ভারত সরকার বাংলার নবীন ময়রার আবিষ্কার বলে জি. আই রেজিস্ট্রেশন দিয়েছেন। উড়িষ্যা সরকার তাতে ভীষণ আপত্তি জানিয়েছিল। এমন কি কোর্টে মামলাও করেছিল। উড়িষ্যার বক্তব্য ছিল সেই প্রাচীনকাল থেকে পুরীর উল্টোরথে “রসগোল্লা ভোগ” প্রচলিত। রথযাত্রা শেষে মন্দিরে ফেরার পর গিন্নির মানভঞ্জনে এই রসগোল্লারই শরণাপন্ন হন জগন্নাথদেব। পুরীর মন্দিরে বছরের এই একটি দিনই মন্দিরের বাইরে তৈরি ভোগ ভিতরে ঢোকে। এগুলো তো প্রাচীন ইতিহাস। তাহলে রসগোল্লা বাংলার হয় কী ভাবে ?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রাচীন উড়িষ্যার “রসগোল্লা” আর ১৮৬৮ সালে নবীন ময়রার তৈরী রসগোল্লা এক বস্তু নয়। কিন্তু এই নিয়ে বিতর্ক চলবে।
এবার আসি মিহিদানায়। গবেষকরা বলছেন, মিহিদানার আবিষ্কর্তা ক্ষেত্রনাথ নাগ এবং মিহিদানার আবিষ্কার হয় আনুমানিক ১৮৩২ সালে (রসগোল্লারও আগে)। কিন্তু মিষ্টিটি তখন মোটেই পপুলার ছিল না।
১৯০৪ সালে লর্ড কার্জন, বর্ধমানের জমিদার বিজয়চাঁদ মহতাবকে “মহারাজা” খেতাব দিতে বর্ধমান আসেন। কার্জনের বর্ধমান আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে বিজয়চাঁদ বর্ধমানের মিষ্টি প্রস্তুতকারক ভৈরবচন্দ্র নাগকে একটি বিশেষ মিষ্টি প্রস্তুত করতে বলেন।
ভৈরবচন্দ্র নাগ তার পূর্বপুরুষ ক্ষেত্রনাথ নাগের রেসিপি দিয়ে মিহিদানা বানিয়ে লর্ড কার্জনকে তাক লাগিয়ে দেন। এরপর থেকেই মিহিদানার জয় জয়কার। তাই মিহিদানা আবিষ্কারের সাল হিসেবে ১৯০৪ টি বহুল প্রচলিত হলেও এটির জন্ম তার ৭২ বছর আগে ! হয়তো তার আগেও অন্য রূপে এবং নামে মিষ্টিটির কোনো পূর্বপুরুষ ছিল।
জগন্নাথদেব কেন মিহিদানা খেতে বর্ধমান ছেড়ে মাহেশে যাবেন? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। এটি একটি মিথ। সম্ভবত মাহেশে স্থান মাহাত্ম্য বোঝানোর জন্যই এটির সৃষ্টি। জগন্নাথ দেবের মাহেশ সম্পর্কিত মিষ্টিটি যে মিহিদানা, সে সম্পর্কে আমার তথ্য সূত্র ছিল সুমনা সাহা নামে এক গবেষকের লেখা একটি বই। বইটির নাম “মাহেশের রথ – ভক্তি বিশ্বাসের এক জীবন্ত রূপকথা”। এই গল্পটি সেই বইয়ে পেয়েছিলাম। সেখানে মিহিদানারই উল্লেখ আছে। এছাড়া “বাজুবন্ধ পালা” বলে একটি প্রাচীন যাত্রাপালার কথা আছে । সেখানেও মিহিদানার কথাই বলা হয়েছে।
কাজেই সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের কথাই শুনুন। বাঘ মানুষ খায় এটা যেমন সত্যি, মিষ্টি প্রিয় বাঙালি মিহিদানা ভালো খায় এটাও সত্যি। তাই গপগপিয়ে মিহিদানা খান আর ধরে নিন জগন্নাথদেব আস্বাদিত মহাপ্রসাদ-ই খাচ্ছেন।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর !