বিয়ে করার সাধ ছিল ষোলোআনা, শুধু সামর্থ্যের অভাবে তার প্রেমিকা হাঁটা দিলো ঘুরপথে। নাকি বয়েস বেড়ে যাচ্ছিলো।
এটা একটা রাতের ঘটনা।
রমাকান্ত তার সযত্নপালিত কুল্লে দুটো সাদা শার্টের একটাকে কয়লার ইস্তিরিতে পালিশ করে আর অন্যটাকে সার্ফ-জলে ভিজিয়ে হাঁটা দিলো রাইটার্স-এর দিকে।
একে বলে সকাল।
কৃষ্ণেন্দু “ইন্টারভিউ যাচ্ছি” বলে সটান পৌঁছে গেলো মিলেনিয়াম পার্ক। মুড়িমাখা দিয়ে লাঞ্চ সেরে পোয়াটাক গ্লানি ও সেরখানেক frustration মাখা ঘুম।
এর নাম দুপুরের অঘটন।
নববিবাহিতরা যে যার ঘরে ফিরলো পড়িমরি করে… ভেটেরান আর হাফ-সোলরা গেলো নানাবিধ আড্ডার উদ্দেশ্যে… ব্যাচেলররা জুড়ি খুঁজছে…
এটা শহরের সন্ধ্যে।
আর দিনের শেষে সেই প্রেমিক, সেই প্রেমিকা, সেই রমাকান্ত আর সেই কৃষ্ণেন্দু, রাতের বালিশে মাথা, জানলার ফাঁক ফস্কে চাঁদে চোখ, জানতেও পারলো না তার চেয়েও দুখী মানুষ পাওয়া যায় এ শহরে।
বাবা কোপা দেখছিলেন। ভোরে উঠতে পারেননি তাই যখন দেখতে শুরু করেছেন তখন খেলা শেষের দিকে। বল পেটাপেটি আমার পছন্দ নয় তাই এমনিতে ফুটবল দেখি না। কাল থেকে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার পোস্টে ফেসবুক ভেসে যাচ্ছে তাই চশমার কাঁচ মুছে ঘুম ঘুম চোখে এসে দাঁড়িয়ে ৫-৬ মিনিট দেখেছি।
রথযাত্রা মানেই বৃষ্টি আর পাঁপড় ভাজা। রথের দিন পাঁপড় ভাজা খায় নি এমন বাঙালি বিরল। অথচ পাঁপড় ভাজা বস্তুটি জগন্নাথদেবের মেনুতেই নেই। জগন্নাথদেব যে বাঙালি খাবারটি খেতে সবচেয়ে ভালোবাসেন সেটি হলো – মিহিদানা !
সে এমনই ভালোবাসা, যে সে গল্পটিও লোকগাঁথায় অমর হয়ে গেছে। কথিত আছে, একবার জগন্নাথ দেবের বঙ্গদেশের মিহিদানা খাওয়ার সাধ হয়। পান্ডাদের ফাঁকি দিয়ে, সবার অলক্ষ্যে রাতের অন্ধকারে পুরীর মন্দির থেকে বেরিয়ে তিনি বঙ্গদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছান শ্রীরামপুরের কাছে গঙ্গার তীরে মাহেশ গ্রামে। সেখানে এক মিষ্টান্নর দোকানে পেট ভরে মিহিদানা খেয়ে তাঁর স্বর্গীয় তৃপ্তি হয়।
কিন্তু এইবার সমস্যা হলো দোকানী মিহিদানার দাম চাইতে। পয়সা তো তাঁর কাছে নেই ! নিজের ডান হাতের মহামূল্যবান বাজুবন্ধটিই হাত থেকে খুলে দোকানীকে দিয়ে দেন তিনি। পরের দিন পুজোর সময় পুরীর মন্দিরের সেবাইতরা দেখেন প্রভুর ডান হাতের বাজুবন্ধটি নেই। খুঁজতে খুঁজতে মাহেশে এসে সেটির খোঁজ পাওয়া গেলো। সন্দেহ রইলো না, মিহিদানা খেয়ে তৃপ্ত হয়ে প্রভু স্বয়ং সেটি রেখে গেছেন মাহেশে।
তাহলে বুঝুন বঙ্গদেশীয় মিহিদানার কী স্বর্গীয় স্বাদ যা স্বয়ং জগন্নাথদেবকে পুরী থেকে টেনে এনেছিল মাহেশে, আর আমরা কিনা পাঁপড় ভাজা নিয়ে পড়ে আছি ! সাধে কী মাইকেল মধুসূদন দত্ত দুঃখ করে লিখেছিলেন “কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল কানন” !
জগন্নাথ কথাটির অর্থ জগতের নাথ – অর্থাৎ তিনি সর্বত্র। এমন কী ইংরেজিতেও তিনি আছেন। সেই 1321 সাল থেকে। ইংরেজির “juggernaut” শব্দটি এসেছে জগন্নাথ থেকে যার অর্থ “a huge, powerful, and overwhelming force” ! চার্লস ডিকেন্স পর্যন্ত শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেই ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত লেখা “লাইফ এন্ড এডভেঞ্চার অফ মার্টিন চাজলউইট” নামক নভেলে।
কাজেই এই রথযাত্রায়, পাঁপড় ভাজার সঙ্গে মিহিদানাও খান ! জগতের নাথ সেই “huge, powerful, and overwhelming force” পর্যন্ত বঙ্গীয় মিহিদানার স্বর্গীয় স্বাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন !
মিথ, ফেয়ারি টেল বা রূপকথা ইত্যাদি নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী একটি অতি খাঁটি কথা লিখে গেছেন। তিনি লিখেছিলেন: “রাজপুত্রর সঙ্গে বাঘের দেখা হলো। বাঘ বললো “হালুম, এবার তোকে খাবো”! এটি রূপকথা সন্দেহ নেই তাই বলে বাঘ যে মানুষ খায় এটা তো সত্যি!”
জগন্নাথ দেবের মিহিদানা প্রীতির যে গল্পটি লিখেছি সেটি এরকমই একটি মিথ। এই মিথ্ নিয়ে অনেকেই জানালেন যে গল্পটা ঠিকই আছে তবে মিষ্টি টা মিহিদানা নয়। ওটা গুটকে সন্দেশ। কেউ আবার বললেন মনোহরা। জনৈক বললেন মিহিদানা ১৯০৪ সালে বর্ধমানে আবিষ্কৃত আর মাহেশের রথ সেই ১৩৯৬। তাছাড়া মাহেশের মিহিদানা বিখ্যাত নয়। কী করে সম্ভব?
জগন্নাথ দেবের প্রিয় মিষ্টি নিয়ে বিতর্ক এই প্রথম নয়। রসগোল্লা বস্তুটিকে ভারত সরকার বাংলার নবীন ময়রার আবিষ্কার বলে জি. আই রেজিস্ট্রেশন দিয়েছেন। উড়িষ্যা সরকার তাতে ভীষণ আপত্তি জানিয়েছিল। এমন কি কোর্টে মামলাও করেছিল। উড়িষ্যার বক্তব্য ছিল সেই প্রাচীনকাল থেকে পুরীর উল্টোরথে “রসগোল্লা ভোগ” প্রচলিত। রথযাত্রা শেষে মন্দিরে ফেরার পর গিন্নির মানভঞ্জনে এই রসগোল্লারই শরণাপন্ন হন জগন্নাথদেব। পুরীর মন্দিরে বছরের এই একটি দিনই মন্দিরের বাইরে তৈরি ভোগ ভিতরে ঢোকে। এগুলো তো প্রাচীন ইতিহাস। তাহলে রসগোল্লা বাংলার হয় কী ভাবে ?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রাচীন উড়িষ্যার “রসগোল্লা” আর ১৮৬৮ সালে নবীন ময়রার তৈরী রসগোল্লা এক বস্তু নয়। কিন্তু এই নিয়ে বিতর্ক চলবে।
এবার আসি মিহিদানায়। গবেষকরা বলছেন, মিহিদানার আবিষ্কর্তা ক্ষেত্রনাথ নাগ এবং মিহিদানার আবিষ্কার হয় আনুমানিক ১৮৩২ সালে (রসগোল্লারও আগে)। কিন্তু মিষ্টিটি তখন মোটেই পপুলার ছিল না।
১৯০৪ সালে লর্ড কার্জন, বর্ধমানের জমিদার বিজয়চাঁদ মহতাবকে “মহারাজা” খেতাব দিতে বর্ধমান আসেন। কার্জনের বর্ধমান আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে বিজয়চাঁদ বর্ধমানের মিষ্টি প্রস্তুতকারক ভৈরবচন্দ্র নাগকে একটি বিশেষ মিষ্টি প্রস্তুত করতে বলেন।
ভৈরবচন্দ্র নাগ তার পূর্বপুরুষ ক্ষেত্রনাথ নাগের রেসিপি দিয়ে মিহিদানা বানিয়ে লর্ড কার্জনকে তাক লাগিয়ে দেন। এরপর থেকেই মিহিদানার জয় জয়কার। তাই মিহিদানা আবিষ্কারের সাল হিসেবে ১৯০৪ টি বহুল প্রচলিত হলেও এটির জন্ম তার ৭২ বছর আগে ! হয়তো তার আগেও অন্য রূপে এবং নামে মিষ্টিটির কোনো পূর্বপুরুষ ছিল।
জগন্নাথদেব কেন মিহিদানা খেতে বর্ধমান ছেড়ে মাহেশে যাবেন? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। এটি একটি মিথ। সম্ভবত মাহেশে স্থান মাহাত্ম্য বোঝানোর জন্যই এটির সৃষ্টি। জগন্নাথ দেবের মাহেশ সম্পর্কিত মিষ্টিটি যে মিহিদানা, সে সম্পর্কে আমার তথ্য সূত্র ছিল সুমনা সাহা নামে এক গবেষকের লেখা একটি বই। বইটির নাম “মাহেশের রথ – ভক্তি বিশ্বাসের এক জীবন্ত রূপকথা”। এই গল্পটি সেই বইয়ে পেয়েছিলাম। সেখানে মিহিদানারই উল্লেখ আছে। এছাড়া “বাজুবন্ধ পালা” বলে একটি প্রাচীন যাত্রাপালার কথা আছে । সেখানেও মিহিদানার কথাই বলা হয়েছে।
কাজেই সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের কথাই শুনুন। বাঘ মানুষ খায় এটা যেমন সত্যি, মিষ্টি প্রিয় বাঙালি মিহিদানা ভালো খায় এটাও সত্যি। তাই গপগপিয়ে মিহিদানা খান আর ধরে নিন জগন্নাথদেব আস্বাদিত মহাপ্রসাদ-ই খাচ্ছেন।
সরস্বতী পুজো র সাথে হাতেখড়ি জড়িয়ে আছে।সরস্বতী পুজো চলছে। তার পাশেই পুরোহিত বা প্রাজ্ঞ এক গুরুজনের কোলে বসে ফুটফুটে শিশুটি স্লেটে চক দিয়ে লিখছে অ, আ, ই, ঈ… ‘হাতেখড়ি’ বলতেই এমন চেনা ছবি ভেসে ওঠে আমাদের মনে। কিন্তু, এই ‘হাতেখড়ি’ আসলে কী? কেন, সরস্বতী পুজোর দিনেই তার এত বাড়বাড়ন্ত?
বলা হয়, বিদ্যার দেবীর আরাধনার দিনে সন্তানের অক্ষর পরিচয় শুরু হলে তাঁদের সন্তান সর্বদাই শিক্ষার সঙ্গে জুড়ে থাকবে- এমন ধারণা থেকেই সরস্বতী পুজোর দিন পুরোহিত বা অন্য কোনও প্রাজ্ঞজনের মাধ্যমে শিশুর হাতেখড়ি দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, শাস্ত্রমতে, পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ গুরু তার মা। শিশুর হাতেখড়ি বা বিদ্যা আরম্ভ তার মায়ের হাত থেকে শুরু হওয়াই তাই বাঞ্ছনীয়। বলা হয়, এতে শিশুটির মেধা বৃদ্ধি ঘটে থাকে। অবশ্য শিশুটির মা যদি না থাকেন, তা হলে তার বাবা এই কাজ করতে পারেন।
প্রসঙ্গত, আজ থেকে দেড়শো-দুশো বছর আগের বাংলায় হাতেখড়ি হতো শুভঙ্করী আর্যা, চৌতিশা বা নামতা শিখে। ১৮৫৫ সালে ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথমবার প্রকাশিত হওয়ার পরই সেই রীতি বদলে গিয়ে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের মাধ্যমে হাতেখড়ি দেওয়ার প্রথা চালু হয়। যা, বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হওয়ার ১৬৫ বছর বাদেও একইরকমভাবে বিদ্যমান।
শুধু হাতেখড়িই নয়, সরস্বতী পুজো মানে স্কুল-কলেজ এবং বাড়ির মেঝেতে দেওয়া আলপনাও। যে কোনও আয়োজনই পূর্ণতা পায় এই আলপনায়। লাভ করে নতুন মাত্রাও। লক্ষ্মীপুজোর মতো না হলেও বাগদেবীর আরাধনার দিনটিতেও আলপনা দেওয়ার উন্মাদনা খুব কম কিছু নয়।
তবে, আলপনা দেওয়া শুধুই মনের খেয়ালে মূর্ত হওয়া কোনও তো কাজ নয়, তার জন্য চাই নিজস্বতাও। আলপনা তো শুধু আঁকা নয়, এক বিশেষ শিল্পরীতি। তার নির্দিষ্ট নকশা রয়েছে। লোকায়ত আলপনাকে ক্ল্যাসিক চেহারা দিয়েছিল শান্তিনিকেতন। ১৯২০ সালে শান্তিনিকেতনে এলেন প্রখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসু, তৈরি হল কলাভবন। তিনি পঞ্চগুড়ি আলপনা দেওয়ার রীতির দিকে না গিয়ে প্রচলিত পদ্ধতিতেই মেতে উঠেছিলেন রঙের খেলায়।
এই আলপনা রয়েছে বিভিন্ন ধরনের। বড় পাতা আর ছোট পাতা আকৃতির আলপনা, পদ্মের উপরে নকশা এঁকে বানানো আলপনা, মাটির থালার উপর নকশা করে আলপনা, বিভিন্ন রঙে তৈরি ফুল দিয়ে করা আলপনা, চার কোণাফুলের নকশার আলপনা ইত্যাদি খুবই জনপ্রিয়। তবে, এর বাইরেও রয়েছে আরও হরেক রকমের আলপনা এবং তার ডিজাইন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে নানা পরিবর্তন এসেছে আলপনার রূপে, রঙে, আঙ্গিকে, প্রকাশে। কিন্তু কখনই তা মূল থেকে দূরগামী হয়নি।
বিভিন্ন লোকায়ত উৎসবই আলপনার অনন্যতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে নিজস্ব ভেঙে।
আমার শেকড় বাংলাদেশের (Bangladesh) ঢাকার “বারদী” (Baradi) গ্রামে। যদিও জন্মকর্ম সবই কলকাতায়। তবে ৮/১০ বছর পর্যন্ত গ্রামের সাথে যোগাযোগ ছিল কারণ আমার ঠাকুমা ওখানে থাকতেন। বাবা,কাকারা চাকরিসূত্রে এবং লেখাপড়ার জন্য এদেশেই থাকতো। ঠাকুমাকে আমরা “দাদামা” ডাকতাম। তাঁর স্নেহ, ভালোবাসার টানে আমরা উন্মুখ হয়ে থাকতাম, কবে তাঁর সান্নিধ্যে আসবো। যেহেতু দেশভাগ তখনও হয়নি কাজেই যাতায়াতের কোনো অসুবিধাই ছিল না। বাবু-কাকুদের সুযোগ হলেই আমরা অবশ্যই চলে যেতাম ওখানে।
শিয়ালদহ স্টেশন (Sealdah Station) থেকে ছাড়তো “গোয়ালন্দ মেল্” (goalanda Mail)। ওই ট্রেনেই আমরা যেতাম। গোয়ালন্দে (Goalanda) নেমে ওখান থেকে বর্ষাকালে স্টিমারে, অন্য সময়ে নৌকায় বারদী (Baradi) পৌছাতাম।
এই গোয়ালন্দ জায়গাটা মনে হয় একটা বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। রেলের জংশন স্টেশন, জাহাজঘাট, ব্যবসাকেন্দ্র সবই ছিল। বিভিন্ন খাবারের দোকান ছিল, বিশেষভাবে ভাতের হোটেল। লোকজন যাওয়া-আসার পথে ওই হোটেলগুলোয় রান্না পদ্মার ইলিশের ঝোল আর গরম ভাতের অমোঘ টানে ওখানে ঢুকতেই হত।
বারদীর স্বনামধন্য লোকনাথ আশ্রমে (Baba Loknath Ashram) গ্রামে ঢুকতে অথবা গ্রাম থেকে বাইরে যেতে অবশ্যই সবাই বাবাকে স্মরণ করতো। লাল মেঝের পাকাঘর আর বারান্দা কিন্তু ছাদ ছিল শনের ছাওয়া। সামনে অনেকটা খোলা জায়গা, তারপর এক “সিদ্ধ বকুল” গাছ। গ্রামের লোকের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ওই গাছের গোড়ার মাটি মাথায়, মুখে দিলে যেকোনো রোগ ভালো হয়।
আমি আমার এই বয়সেও সেই মাটি কোনোভাবে যোগাড় করতে পারলে রাখি কেউ কোনো শুভ কাজে যাওয়ার সময় তাঁর মাথায় ঠেকাই। কয়েক বছর আগে আমার এক ভাই আর এক ভাইপো আমাকে এনে দিয়েছিলো সেই পবিত্র মাটি।
যাইহোক আশ্রমে পৌঁছনোর পরে ওখানে প্রসাদ খেতাম পেট ভরে। সেখানে বাড়ি থেকে দাদামা, যারা চাষবাস করতেন তাদের পাঠিয়ে দিত আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমাদের বাড়ি আশ্রম থেকে মাইল খানেক দূরে ছিল। ছয়/সাত বছর বছর বয়সে ওই পথ হেঁটে যাওয়া অসম্ভব ছিল। কাজেই “ইয়াদালী”, “আককাছআলী” কাকুদের কোলে কোলেই যেতাম।
দাদামা উঠানে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতো। আমাদের দেখতে পেলেই একমুখ হাসি নিয়ে দুহাত বাড়িয়ে আমাদের আদর করতো।
আদরের বহর শেষ হতো নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, খিরের সন্দেশ ইত্যাদি দিয়ে। তারপর ক্লান্তি ও আদরের আবেশে ঘুম এসে যেত।
সকালে ঘুম থেকে উঠে জলখাবার ছিল ফেনাভাত সঙ্গে বাড়ির তৈরী ঘি। এই ফেনাভাতকে বলতো “জাউ”। বেশ লালচে ভাতটা খেতেও খুব স্বাদ। তারপর ছিল মাছ ধরার পালা। জেলেরা যেত জাল নিয়ে কাকুরা খালি হাতে শুধু একটা করে গামছা নিয়ে। বড় পুকুর, তাকে বলতো “বিল”।
একদিকে জেলেরা জাল ফেলেছে আর কাকুরা অন্যদিকে বিলে নেমে যেত। কাকুরা যে কি কায়দায় পা দিয়ে দিয়ে মাছ ধরতো আর পাড়ে আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম, আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিত। আমরা সেগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে মাছ রাখার জায়গায় রাখতাম। মাছ ধরার জায়গার নাম ছিল “ডুলা”।
গ্রামের বেশির ভাগ মুসলমান সম্প্রদায় খুবই গরিব ছিল। সেই সব বাড়ির মহিলারা অনেক বাড়িতে কাজ করতো সংসার চালানোর জন্য। তারা উঠান নিকানো, ধান সেদ্ধ করে ওই উঠানে শুকোতে দিতো, ধান ভেঙে চাল তৈরী করতো। এছাড়াও যাবতীয় বাইরের কাজে তাদের পাওয়া যেত। উঠোনের এক ধারে একসঙ্গে দুটো মাটির উনুন তৈরী করা ছিল কাঠের জ্বালের। তাকে বলতো “দোআখা”। সেই উনুনের ধান সেদ্ধ, মুড়িভাজা, পিঠে-পায়েস রান্না করা সবই হতো।
জ্বালানি ছিল ধান গাছের গোড়া, যাকে বলতো “নাড়া”, গাছের ডালপালা। আর একটা জিনিস যার নাম মনে করতে পারছি না কিন্তু বানাতে দেখেছি। এক-দেড় হাত লম্বা মোটা পাঠকাঠির গায়ে গোবর চেপে চেপে আটকিয়ে শুকিয়ে রাখা হতো। তাই সারা বছর জ্বালানি হিসাবে খুব ভালো ছিল। এইসব কাজের বিনিময় ওরা চাল, মুড়ি, গাছের শাক-সবজি, পুকুরের মাছ ইত্যাদি পেত। নগদ পয়সার অভাব ছিল কাজেই সেটা খুব কমই পেত।
প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি মাছ ধরা হতো। সেই সব মাছ বাড়ি বাড়ি বিলিয়েও শুক্তো থেকে ঝালে-ঝোলে-অম্বলে খেয়ে শেষ হতো না। খাবার পরে বিশ্রামের জায়গা ছিল আমবাগানে। আম গাছের তলা রোজই ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করা হতো। সেখানেই বাংলার বিখ্যাত শীতলপাটি পেতে শুতাম আমরা। গাছ থেকে টুপটাপ আম পড়তো, তা কুড়োবার জন্য আমরা শোয়া থেকে উঠলেই বাবু-কাকুদের বকুনি খেতাম।
বিকেলে ইয়াদালি বা আককাছআলী কাকুর যেকোনো একজন আম রাখার জায়গা নিয়ে আসতো যার নাম ছিল “ঢুলঢুলী”। ওই আম বাগানের পাশ দিয়ে একটা খাল ছিল, তাতে বেশ স্রোতও ছিল। পরিষ্কার টলটলে জল তাতে আমরা সকলে স্নান করতাম।
বাড়ি আর আম বাগানের মধ্যে ছিল গরুর গাড়ি চলার রাস্তা। উঠোন ঘিরে চারপাশে ঘর ছিল। রাস্তার পাশেই ছিল দুটো ঘর। একটা শোবার ঘর আর একটা বৈঠকখানা। ওই বৈঠকখানার কোনায় ছিল একটা কাঁচামিঠে আমের গাছ। আমি এখানেও কাঁচামিঠে আম দেখি, কিন্তু ওই গাছের আমের মত এত বড় বড় আম আমার নজরে পড়েনি। মনে হয় একেকটা ২ সেরের (around 1.8 kgs) মত ওজন। খেতেও তেমনি আস্বাদ।
দাদামার শোবার ঘরটা খুব উঁচু ও বড় ছিল। তাতে একটা খুব বড় চৌকিতে বিছানা। সেই ঘরটায় ছোট একটা ভাগ করা ছিল। তারমধ্যে রোজের খরচ করার মত চাল, ডাল, তেল, ঘি ইত্যাদি থাকতো। আর একটা বাঁশের খুব মজবুত সিঁড়ি ছিল উপরে ওঠার জন্য। তার মেঝেটা ছিল কাঠের পাটাতনের, ছোট জানালাও ছিল কয়েকটা। ওখানে থাকতো সারা বছরের চাল, বিভিন্ন ডাল, তেল, ঘি, আমসত্ত্ব, আচার, কাসুন্দি ইত্যাদি। সেই সময়ের একটা দরজা ছিল যেটা খুলে ঢুকতে হতো, নামার সময় বন্ধ করা হতো। আমিষ-নিরামিষ দুটো রান্নাঘর ছিল, তার পেছনে কুয়োতলা।
ঐখানেও একটা আমগাছ ছিল, “গোলাপখাস”। সেই আম পাকলে একেবারে গোলাপফুলের গন্ধ মম করতো চারপাশ। অসম্ভব মিষ্টি ছিল সেই আম, কিন্তু ছোট ছোট ছিল আকারে।
আমার ৬/৭ বছর বয়সে এক মাসতুতো দিদির বিয়েতে গিয়েছিলাম, ঢাকা (Dhaka) জেলার “হাসাড়া” নামক গ্রামে। পদ্মা (Padma) নদীর গা ঘেঁষা সে গ্রাম। ছোটবেলায় আমি নাকি খুব দুরন্ত ছিলাম কাজেই ঘরে কে কি করছে সে দিকে আমার মন ছিল না যতটা ছিল বাইরের দিকে।
বিয়েবাড়ির বিশেষ কিছুই মনে নেই, বাদে দুএকটা ঘটনা। মাসির বাড়ির দুইপাশে বড় বড় দুটো পুকুর ছিল। সেই একটা পুকুরে দেখলাম বড় বড় বাঁশ ফেলা রয়েছে। ওদের বাড়িতে যারা গরু-বাছুর চড়াতো বা চাষবাসের কাজ করতো তাদের কাজ ছিল আমাদের ছোটদের দেখভাল করার। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম জলে কেন বাঁশ রয়েছে? তাতে ওরা জানালো গ্রামে যখন খুশি মাংস পাওয়া যায় না, সেই জন্য প্রয়োজন মত কচ্ছপের মাংস খাওয়া হয়।
কিছুই বুঝতে পারলাম না কথার অর্থ! পরে বুঝলাম ব্যাপারটা কি। এরই মধ্যে একদিন দেখলাম দুটো বাঁশে উপর অজস্র ছোট ছোট কচ্ছপ উঠে বসে রয়েছে। পুকুরে স্নান, কাপড় কাচা, বাসন মাজা সবই চলছে কিন্তু সেই কচ্ছপগুলো তাদের জায়গায় ঠিক বসে রয়েছ। সেখান থেকেই ধরে এনে মাংসের ব্যবস্থা করা হতো।
এই রকমই আরেকটা ঘটনা হলো, পদ্মার থেকে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরে এনে ভিতর বাড়ি দিয়ে একটা পুকুরের পাড়ে জমা করা হয়েছে, পাঁচ ছয়জন মিলে সেই মাছ কেটে পুকুরের পাড়ে কলাপাতার উপর জমা করছে। সেই কাটা টুকরোগুলো আর ধোয়া হবে না। সেখান থেকে নিয়েই রান্না হবে।
তখন খানিক বড় হয়েছি, বছর নয়/দশ হবে। আমাদের গ্রামে ঢুকতে প্রথমে আমার বাবুর জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি ছিল তারপর খান চারেক বাড়ি পরে আমাদের বাড়ি। সেই জ্যাঠামশাই এর মেয়ের বিয়ে। তখন বর্ষাকাল। নদীমাতৃক বাংলার নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুর… সব জলে একাকার। দেখে বোঝবার উপায় নেই কোনটা রাস্তা, কোনটা পুকুর। সবুজ, সতেজ প্রকৃতি। জীবনানন্দের বাংলার বিবরণ চাক্ষুস করেছিলাম প্রাণ ভরে।
বিয়ের আগের দিন সন্ধেবেলা আমরা নদীর ঘাট থেকে সোজা গিয়ে পৌঁছলাম বাড়ির পুকুর ঘাটে। সেখানে আলো নিয়ে বাড়ির পিসিমা, কাকিমা, জেঠিমা সবাই আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। সেখানেই অনেক আদর খেয়ে বাড়ি ঢুকে মন খারাপ হয়ে গেলো দাদামাকে না দেখে। সবাই বললো খালি বাড়ি রেখে দাদামা আসতে পারেনি, কাল সকালেই আমরা গিয়ে দাদামাকে নিয়ে আসবো।
সকালেই মাঝিরা নৌকা নিয়ে তৈরী। দিদি, আমি, বাবু আর ছোট কাকু রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। গ্রাম বাংলার কি যে শোভা সেদিন চাক্ষুস করলাম। সেই রূপ বোধয় জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব ভাষায় প্রকাশ করার। পুকুর ছেড়ে নৌকা পড়লো ধানক্ষেতে। ওখানে জল বেশি নেই খুব জোর কোমর জল। কারণ মাঝিরা মাঝে মাঝেই নৌকা থেকে জলে নেমে একটু ঠেলে নৌকা নিয়ে যাচ্ছে।
সেই ঠেলায় ও নৌকার গতিতে ধানগাছগুলো নৌকার দুপাশে সরে সরে যাচ্ছে। টলটলে জলের নিচে ছোট ছোট মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাছে গাছে পাখির কলকাকলি। সাথে মনরম প্রভাতি বাতাস। এ যেন অন্য পৃথিবী! আজও এই জীবন সায়াহ্নে এসে অমলিন ও স্থায়ী সেই সুখস্মৃতি। যাইহোক নৌকা ঘরের ঘাটে এসে দাঁড়ালে, মাঝিরা নৌকা থেকে কোমর জলে নেমে আমাদের কোলে করে একেবারে উঠোনে নামিয়ে দিলো। উঠোনে দেখি মাচা ভর্তি শশা ফলে আছে। দাদামা ওগুলো তোলেনি, আমরা এসে গাছ থেকে তুলবো বলে। দাদামা তো আমাদের অপেক্ষায় পথ চেয়েই রয়েছে। এরপর দাদামার আদর ও দাদামার হাতের নানারকমের নাড়ু, মোয়া, আমসত্ত্ব, ক্ষীর ইত্যাদি পেয়ে বিয়ে বাড়ির কথা বেমালুম ভুলে গেলাম।
একবার গ্রীষ্মকালে দাদামার সঙ্গে আমাকে আর দিদিকে বাবু রেখে এসেছিলো। তখন আমরা ছাড়া গরু! শাসন করবার কেউ নেই, সঙ্গে দাদামার আস্কারা তো ছিলই। যথেচ্ছ আম খেয়ে দিদি ও আমার মুখভর্তি ঘা হয়ে গিয়েছিলো। আমার মা ও মেজকাকু আনতে গিয়ে আমাদের হাল দেখে মা খুব বকলো আর মেজকাকু দাদামাকে নিয়ে পড়লো।
যাইহোক আসতে তো হবেই। খুব মন খারাপ, খুব কান্নাকাটি করে মা আর মেজকাকুর সাথে চলে আসলাম, দাদামাকে একা ফেলে। সেই শেষবার গিয়েছিলাম দেশের বাড়িতে। দাদামা পরে কোলকাতাতে চলে আসে এবং এখানেই মৃত্যুবরণ করে। তবে সোনার বাংলার স্মৃতি কোনোদিনই ভোলার নয়। কবি সেই জন্যই লিখেছিলেন , “সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, সার্থক জনম মা গো, তোমায় ভালোবেসে”।